বীরপুরূষ
মনে করাে , যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে ।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে , মা , চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে ,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘােড়ার পরে
টগবগিয়ে তােমার পাশে পাশে ।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলােয় মেঘ উড়িয়ে আসে ।
সন্ধে হল , সূর্য নামে পাটে ,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে ।
ধূ ধূ করে যে দিক - পানে চাই ,
কোনোখানে জনমানব নাই ,
তুমি যেন আপন মনে তাই
ভয় পেয়েছ - ভাবছ , ' এলেম কোথা '।
আমি বলছি , “ ভয় কোরাে না মা গো ,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা । '
চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে ,
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গােরু বাছুর নেইকো কোনােখানে ।
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে ,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে—
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালাে ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে ,
দিঘির ধারে ওই - যে কিসের আলাে ?
এমন সময় হাঁরে রে রে রে রে ’
এই - যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে
তুমি ভয়ে পাল্কিতে এক কোণে
ঠাকুর - দেবতা স্মরণ করছ মনে ।
বেয়ারাগুলাে পাশের কাঁটাবনে ।
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরােথরাে ।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে ,
আমি আছি , ভয় কেন , মা , করাে ।
হাতে লাঠি , মাথায় ঝাঁকড়া চুল
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল ।
আমি বলি , “ দাঁড়া খবরদার ,
এক পা কাছে আসিস যদি আর
এই চেয়ে দেখ আমার তলােয়ার ,
টুকরাে করে দেব তােদের সেরে ।
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
চেঁচিয়ে উঠল হাঁরে রে রে রে ' ।
তুমি বললে , ' যাস নে খােকা ওরে !
আমি বলি , “ দেখাে না চুপ করে ।
ছুটিয়ে ঘােড়া গেলেম তাদের মাঝে ,
ঢাল তলােয়ার ঝঝনিয়ে বাজে ,
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে ।
শুনে তােমার গায়ে দেবে কাঁটা ।
কত লােক যে পালিয়ে গেল.ভয়ে ,
কত লােকের মাথা পড়ল কাটা ।
এত লােকের সঙ্গে লড়াই করে
ভাবছ খােকা গেলই বুঝি মরে ।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে ।
বলছি এসে , ' লড়াই গেছে থেমে ।
তুমি শুনে পালকি থেমে নেমে
চুমাে খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে ।
বলছ , ' ভাগ্যে খােকা সঙ্গে ছিল ,
কী দুর্দশাই হত তা না হলে ।
রােজ কত কী ঘটে যাহা তাহা -
এমন কেন সত্যি হয় না আহা ?
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে ,
শুনত যারা অবাক হত সবে
দাদা বলত , কেমন করে হবে ,
খােকার গায়ে এক কি জোর আছে ।
পাড়ার লােকে সবাই বলত শুনে ,
ভাগ্যে খােকা ছিল মায়ের কাছে ।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন